শহীদ ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের, বীর উত্তম এর শাহাদাৎ বার্ষিকীতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শ্রদ্ধাঞ্জলি
আজ মহান মুক্তিযুদ্ধে জীবন উৎসর্গকারী শহীদ ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের, বীর উত্তম-এর ৫৪তম শাহাদাৎ বার্ষিকী। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছে এই অকুতোভয় বীরকে।
                                             
ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে প্রশিক্ষনার্থী হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৯ সালে আর্টিলারি কোরে কমিশনপ্রাপ্ত হন এবং ১৯৭০ সালে হায়দ্রাবাদ ক্যান্টনমেন্টে ৪০ ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারিতে ক্যাপ্টেন হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭১ সালে ১৯ ফেব্রুয়ারি ছুটিতে থাকাকালীন চট্টগ্রামে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ের অল্প কয়েকদিন পর যুদ্ধ শুরু হলে বদ্ধ ঘরে স্থির থাকতে পারেননি ক্যাপ্টেন কাদের। মেহেদীর রং ম্লান না হতেই সংসারের মায়া ত্যাগ করে বিয়ের ৫১ দিনের মাথায় ২৮ মার্চ বন্ধুর বাসায় যাবার কথা বলে ফেনীর শুভপুরে ইপিআর বাহিনীর সাথে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। পরবর্তীতে তিনি ৮ ইস্ট বেঙ্গলের সাথে মহালছড়ি এলাকায় যোগদান করে।
 
 
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী চট্টগ্রাম অঞ্চলে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে বুঝতে সক্ষম হয় যে, রামগড়ই মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর হিসেবে চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রতিরোধ যুদ্ধ পরিচালনা করছে। তাই পাকিস্তান সেনাবাহিনী রামগড়ের প্রতিরক্ষা বুহ্য ধ্বংস করার জন্য অগ্রসর হতে থাকে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২টি কোম্পানি রাঙামাটি থেকে মহালছড়ির দিকে অগ্রসর হয়ে কচুছড়িতে এসে পৌঁছলে তাদেরকে প্রতিরোধ করার জন্য মহালছড়ি সদর দপ্তর থেকে মেজর শওকত, ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান এবং ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের নির্দেশপ্রাপ্ত হন। নির্দেশিত হয়ে ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান নানিয়ারচর বাজারে একটি পাহাড়ের ওপর এবং ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের মহালছড়ি-নানিয়ারচর সড়ক অবরোধ করার জন্য স্ব স্ব কোম্পানি নিয়ে অবস্থান গ্রহণ করে। লেফটেন্যান্ট মাহফুজকে তাঁর সেনা দল নিয়ে পার্শ্ববর্তী বাজারে সংরক্ষিত রাখা হয়।
 
২৭ এপ্রিল দুপুর সাড়ে ১২টায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী নানিয়ারচর এলাকায় ক্যাপটেন খালেকুজ্জমানের অবস্থানের উপর আক্রমণ করে। আক্রমণের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে লেফটেন্যান্ট মাহফুজ ২টি কোম্পানি নিয়ে ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামানের সাহায্যে এগিয়ে যান। মেজর শওকত ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদেরকেও তাঁদের সাহায্যে এগিয়ে যেতে নির্দেশ দেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বাত্মক প্রতিরোধের পরেও পাকিস্তানিরা বেপরোয়া হয়ে উঠে। পাকিস্তানি বাহিনীর সেনা ছিল প্রায় ৪ গুণ। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেললে ক্যাপ্টেন আফতাবের সহযোদ্ধারা তাকে পিছু হটার পরামর্শ দেন।
 
কিন্তু ক্যাপ্টেন আফতাব পিছু না হটে সহযোদ্ধা শওকত, ফারুক ও ২ ইপিআর সেনাকে নিয়ে ৩টি এলএমজির অবিরাম গুলিবর্ষণের মধ্য দিয়ে কোণঠাসা করে ফেলেন শত্রুদের।
 
এই চরম মুহূর্তে হঠাৎ এক মুক্তিযোদ্ধার এলএমজি যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ফায়ারিং বন্ধ হয়ে গেলে শতাধিক মুক্তিযোদ্ধার জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। অস্থির হয়ে উঠেন ক্যাপ্টেন আফতাব। মেরামতের জন্য অস্ত্রটি আসতে দেরি হচ্ছিল দেখে ক্যাপ্টেন আফতাব নিজেই ক্রলিং করে এগিয়ে যেতেই কয়েকটি গুলি এসে তার পেটের বাম পাশে এবং ডান বাহুর নিচে লাগে। এই অবস্থায়ও মেশিনগান ধরে ছিলেন ক্যাপ্টেন আফতাব। তখন সহযোদ্ধা শওকত আলী এবং সিপাহী ড্রাইভার আব্বাস আহত ক্যাপ্টেন কাদেরকে একটি জিপযোগে রামগড়ে আনার পথে গুইমারায় আহত ক্যাপ্টেন কাদের পানি পান করতে চাইলে পান করানো হয়, আর সেখানেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
 
 
২৭ এপ্রিল বিকালে শহীদ ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদেরের মরদেহ রামগড় নিয়ে আসা হয়। সন্ধ্যার প্রাক্কালে রামগড়ে জানাজা নামাজ শেষে পূর্ণ সামরিক ও ধর্মীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়।
 
 
ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদেরের (ইকবাল) জন্ম ১৯৪৭ সালে ২৫ ডিসেম্বর দিনাজপুর শহরে। তবে পৈত্রিক গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলার (তৎকালীন বৃহত্তর নোয়াখালী) রামগঞ্জ থানাধীন টিওড়া গ্রামে। পিতা স্থায়ী নিবাস গড়ে তোলেন পুরাতন ঢাকার ফরিদাবাদ এলাকার লাল মোহন পোদ্দার লেনে। সেখানেই অকুতোভয় এই সৈনিকের শৈশব কাটে। যুদ্ধ পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ ও গৌরবোজ্জ্বল অবদানের স্বীকৃতির স্বরূপ ১৯৭৪ সালে ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদেরকে মরণোত্তর ‘বীর উত্তম’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। তাঁর নামে খাগড়াছড়ি জেলা সদরে স্মৃতিসৌধ, মহালছড়িতে স্মৃতি ভার্স্কয, মহালছড়িতে শহীদ ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের উচ্চ বিদ্যালয়, রামগড় বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়নের রাস্তার নামকরণ এবং শহীদ ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের বিদ্যা নিকেতন নামে রামগড়ে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা হয়।
 
বাংলাদেশ আর্মি 
 
                                         
                                        
মন্তব্য করুন: