রঙে সোনালি, গন্ধে মাতাল, স্বাদে অতুলনীয়-ফলের রাজা ‘আম’ শুধু উপমায় নয়, রসনার রাজত্বেও তার আসন অটুট শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। হিমসাগর, ল্যাংড়া, আম্রপালি, গোপালভোগ, ফজলি-প্রতিটি জাতের আম যেন একেকটি চরিত্র, একেকটি গল্প।
তবে বিজ্ঞান ও প্রকৃতির মিলনে জন্ম নেওয়া আম্রপালি আমের গল্পটি একটু ব্যতিক্রম, একটু রোমাঞ্চকর। যার ইতিহাস অনেক আমপ্রেমীরই অজানা।
বর্তমানে বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে প্রায় ৮০০ জাতের আম। তবুও উচ্চফলনশীল, সুস্বাদু ও উন্নত জাতের আম উদ্ভাবনে বিজ্ঞানীরা নিরলস গবেষণা করে চলেছেন। এই সব জাতের ভিড়ে আম্রপালি আম রঙে, গন্ধে, স্বাদে একেবারে অনন্য।
চলুন জেনে নেওয়া যাক আঁশহীন, সুমিষ্ট ও রসালো এই আমের নামকরণের পেছনের রোমাঞ্চকর এক ইতিহাস-
প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের কথা। প্রাচীন ভারতে বৈশালী নামে এক রাজ্য ছিল। সেই রাজ্যের এক আমবাগানে জন্ম নেয় এক কন্যাশিশু। নগরের উদ্যানপালক শিশুটিকে লালন-পালনের দায়িত্ব নেন। আমবাগানে জন্ম ও উদ্যানপালকের আশ্রয়ে মানুষ হওয়ার কারণে শিশুটির নাম রাখা হয় ‘আম্রপালি’।
‘আম্র’ শব্দটি সংস্কৃত ভাষায় ব্যবহৃত হয়, যার মূল শব্দ ‘আম্ব’ (পালি ভাষায়), যার অর্থ পল্লব বা কচি পাতা। এটি মূলত আম গাছের নবীন পাতা বা মুকুলকে বোঝায়। ফলে ‘আম্রপালি’ নামের মধ্যেই লুকিয়ে আছে আম ও প্রকৃতির নিবিড় যোগ।
আম্রপালি মেয়েটি কেবল রূপে নয়, গুণেও ছিলেন অনন্য। তিনি গান গাইতেন, নাচতেন, বীণা বাজাতেন এবং পালি ভাষায় কবিতা লিখতেন। একসময় হয়ে ওঠেন বৈশালীর সেরা নর্তকি। তার রূপে-গুণে মুগ্ধ হয় দেশ-বিদেশের রাজা-রাজপুত্র ও সাধারণ মানুষ। শুরু হয় দ্বন্দ্ব-সংঘাত, কারণ সবাই তাকে দেখতে ও বিয়ে করতে চায়।
এই অবস্থায় তার পালক মা-বাবা চিন্তিত হয়ে বৈশালীর গণ্যমান্যদের সঙ্গে পরামর্শ করেন। দীর্ঘ আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয়-আম্রপালিকে কেউ বিয়ে করতে পারবে না। কারণ তার অতুল রূপ-গুণের অধিকার এককভাবে কেউ পেতে পারে না। ফলে তাকে বৈশালীর ‘নগরবধূ’ হিসেবে ঘোষণা করা হয় একটি ব্যতিক্রমী ও ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত।
নগরবধূ হওয়ার পর আম্রপালি বিপুল ধনসম্পদের মালিক হন। তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে দেশ-বিদেশে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তিনি সবকিছু ছেড়ে গৌতম বুদ্ধের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। ইতিহাসের পাতায় তিনি পরিচিত হন এক বিরল চরিত্র হিসেবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আম্রপালি আমের নাম কীভাবে হলো? উত্তর ভারতের দোসেরি জাতের পুরুষ পরাগ এবং দক্ষিণ ভারতের নীলম জাতের স্ত্রী পরাগের সংকরায়ণের মাধ্যমে ভারতের গবেষকরা একটি নতুন আমের জাত উদ্ভাবন করেন। এই আম স্বাদে, গন্ধে এবং গঠনে ছিল ব্যতিক্রমী। আর তাই এই বিশেষ জাতের নাম রাখা হয় ইতিহাসখ্যাত নগরবধূ ‘আম্রপালি’র নামে।
একটি আমের নামের পেছনে এতটা ইতিহাস, সংস্কৃতি আর রোমাঞ্চ থাকতে পারে তা আম্রপালি না জানলে হয়তো বিশ্বাসই হতো না। এ যেন ইতিহাস আর স্বাদের অপূর্ব মেলবন্ধন।
প্রথমবারের মতো এই জাতের চারা রোপণ করা হয় ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলায়। সেখান থেকে এটি ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশেও। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) একজন কর্মকর্তা ভারত সফরে গিয়ে আম্রপালির কিছু চারা সংগ্রহ করে ঢাকার খামারবাড়িতে রোপণ করেন।
১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) এই জাতকে আনুষ্ঠানিকভাবে অবমুক্ত করে এবং নাম দেয় ‘বারি আম-৩’। বর্তমানে কেউ কেউ এই আমকে ‘আম রুপালি’ নামেও ডাকেন।
আম্রপালি আমের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই আম দেখতে ছোট থেকে মাঝারি আকারের, নিচের দিকে সুঁচালো এবং ওপরের দিকে গোলাকার। পাকা আমের রং হয় হলুদাভ সবুজ, কখনো লালচে কমলা। খোসা কিছুটা মসৃণ ও তেলতেলে।
এই আমের মিষ্টতার মাত্রা ল্যাংড়া বা হিমসাগরের চেয়েও বেশি। এতে রয়েছে উচ্চ মাত্রায় বিটা ক্যারোটিন, যা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। আম্রপালি গাছে গুচ্ছ ধরে অনেকগুলো আম একসঙ্গে হয়। তবে গাছটির আয়ু তুলনামূলকভাবে কম। পাকা আম্রপালি সাধারণত জুন মাসের মাঝামাঝি থেকে বাজারে আসে এবং বেশ কয়েকদিন ঘরে সংরক্ষণ করা যায়।
সোর্স: জাগোনিউজ২৪.কম
মন্তব্য করুন: