হিজরি নববর্ষ মুসলিম জাতির এক অনন্যোজ্জ্বল গৌরবগাঁথা ও ইতিহাসের দিন। নিজেদের অস্তিত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বিশ্ব মুসলিমকে নব চেতনায় উদ্দীপ্ত করতে হিজরি নববর্ষ অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
মুসলমানদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় সকল আচার অনুষ্ঠান ও ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিধি-বিধান বা ইবাদত এই হিজরি তারিখের উপর নির্ভরশীল। ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ যেমন- রোজা, ঈদ, হজ, লাইলাতুল কদর, লাইলাতুল বরাত, লাইলাতুল মিরাজ, আশুরাসহ সকল ধর্মীয় উৎসব পালন করতে হয় হিজরি তারিখ তথা চাঁদের হিসেবের উপর। তাই ইসলামে এ দিনটি সমগ্র মুসলিম জাতির জন্য এক বিশেষ স্মারক।
চাঁদের হিসেবে সব ইবাদতের প্রচলন হযরত আদম আলাইহিসসালাম এর সময় থেকে প্রচলিত ছিল। কিন্তু হিজরি বর্ষ বা সন গণনার প্রবর্তন হয় ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর ফারুক (রা.) এর খেলাফতের চতুর্থ বছর (৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দ) থেকে।
তখন তিনি অর্ধ পৃথিবীর শাসনকর্তা ছিলেন। হিজরি সন এমন একটি সন, যার সঙ্গে মুসলিম উম্মাহর তাহজিব-তামাদ্দুনিক ঐতিহ্যের ভিত্তি সম্পৃক্ত। এটি এমন একটি স্মারক, যার সঙ্গে জড়িত আছে বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রিয় ও পুণ্যময় জন্মভূমি মক্কানগরী ত্যাগ করে বিরহ বেদনা নিয়ে মদিনা শরিফ গমনের ঐতিহাসিক ঘটনা।
হিজরি সন আমাদের মনে করিয়ে দেয় কিভাবে অবিশ্বাসীরা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পৃথিবী হতে সরিয়ে দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তিনি আজও জাগরূক হয়ে আছেন মুসলিম বিশ্বে। মহররম মাস শুধুমাত্র কারবালার ঘটনা স্মরণ করার মাসই নয়, এমাস গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার, ত্যাগের, ভালো কাজ করার, খারাপ কাজ হতে বেঁচে থাকার এবং মুসলিম বিশ্বকে নতুন করে গড়ার প্রতিজ্ঞা করার মাস। হিজরি নববর্ষ আমাদেরকে ইসলামের ত্যাগের আদর্শের দিকেই আহবান করে।
যেভাবে এল হিজরি সন
হিজরি সনের শুরু রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মক্কা থেকে মদিনা হিজরতের সময় থেকে। হিজরি সন কবে চালু হয় তা নিয়ে অবশ্য মতভিন্নতা আছে। একটি মত হলো রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা থেকে মদিনা মুনাওয়ারায় আগমন করেন রবিউল আউয়াল মাসে। ওই সময় থেকে তারিখ গণনা শুরু হয়।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামই তারিখ গণনার নির্দেশ দেন। ইমাম জুহরির এমন একটি বর্ণনা মুহাদ্দিস হাকিম তার ইকলিল নামের কিতাবে উল্লেখ করেছেন।
এ সম্পর্কে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ভাষ্য হলো দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর (রা.) এর খেলাফত আমলে হিজরি সনের তারিখ গণনা শুরু হয়। একদা হজরত আবু মুসা আশআরি (রা.) খলিফা হজরত উমর (রা.)-কে পত্র লিখে বলেন, আপনার নির্দেশগুলো আমাদের কাছে এসে পৌঁছলেও এতে তারিখ উল্লেখ নেই। হজরত উমর (রা.) ১৭ হিজরিতে তারিখ নির্ধারণের বিষয়ে পরামর্শ করার জন্য বিশিষ্ট সাহাবায়ে কিরামদের সহযোগিতা চান।
এ সম্পর্কে আয়োজিত সভায় সাহাবায়ে কিরামদের কেউ নবুওয়াতের সূচনা থেকে তারিখ গণনার প্রস্তাব দেন। কেউ প্রস্তাব দেন হিজরত থেকে আবার কেউ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওফাতের দিন থেকে তারিখ গণনার। সাহাবায়ে কিরামদের এসব প্রস্তাব শোনার পর হজরত উমর (রা.) হিজরতের দিন থেকে ইসলামি তারিখ গণনার পক্ষে বলেন। তিনি যুক্তি দেখান হিজরতের মাধ্যমে সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য সূচিত হয়। সাহাবারা এ প্রস্তাবকে সাদরে গ্রহণ করেন।
হিজরতের সময়কে ইসলামি সন গণনার সূচনাকাল ধরা হলেও মহররম মাসকে প্রথম মাস হিসেবে ধরা হয়। কারণ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রবিউল আউয়াল মাসে হিজরত করলেও মক্কা থেকে মদিনা মুনাওয়ারায় যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন মহররম মাসে। মহররম মাসকে ইসলামি সন বা হিজরি সনের প্রথম মাস নির্ধারণের পেছনে পবিত্র কোরআনের একটি নির্দেশনা গুরুত্ব পেয়েছে।
পবিত্র কুরআনে চারটি মাসকে সম্মানিত বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, এ চারটি মাস হলো জিলকদ, জিলহজ, মহররম ও রজব। মহররম মাসে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হিজরতের ইচ্ছা ঘোষণা করায় এবং এ চারটি সম্মানিত মাসের অন্যতম হওয়ায় তা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।
আরেক বর্ণনায় জানা যায়, আল-উকদুদ দিরায়া নামক গ্রন্থে রয়েছে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা উমর (রা.)-এর শাসনামলে উমর (রা.)-এর কাছে একটি চুক্তিপত্র আনা হয়। সেখানে শাবান মাসের কথা উল্লেখ ছিল। তখন উমর (রা.) বললেন, এটা কি গত শাবান না আগামী শাবান মাস? অতঃপর তিনি তারিখ গণনার নির্দেশ দিলেন এবং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মদীনায় হিজরতকে কেন্দ্র করে হিজরি সন গণনার সূচনা করেন।
এসময় মুহাররমকে প্রথম মাস হিসেবে গণ্য করা হয়। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হিজরত করেন ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ১৬ জুলাই। সেই দিনকে মুহাররম মাসের শুক্রবার হিসেবে ধরে হিজরি সাল গণনা শুরু হয়। উক্ত হিজরি হিসেবের প্রথম প্রয়োগ ঘটে উমর (রা.)- এর শাসনামলের ৩০ জমাদিউল উখরা / ১৭ হিজরি অর্থাৎ ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দের ১২ জুলাই থেকে।
এরই ধারাবাহিকতায় আজও হিজরি সন চলে আসছে। হিজরি সন গণনার পূর্বে আরবরা আরবি মাসগুলো ব্যবহার করতেন। অন্যান্য সব সনের মতো হিজরি সনেও ১২টি মাস রয়েছে।
আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেন, নিশ্চয়ই আকাশ মণ্ডলি ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর বিধানে আল্লাহর নিকট মাস গণনার বারোটি মাস, তন্মধ্যে চারটি সম্মানিত। (সুরা তাওবাহ: আয়াত-৩৬)
এ আয়াতের চারটি সম্মানিত মাসকে চিহ্নিত করতে গিয়ে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিদায় হজের সময় মিনা প্রান্তরে দাঁড়িয়ে বলেন, তিনটি মাস হলো জিলকদ, জিলহজ ও মুহররম এবং অপরটি হলো রজব। (তাফসির ইবনে কাসির)।
আমাদের দেশে হিজরি বর্ষ: ফেলে আসা দিনগুলোর মনিকে মুছে ফেলে ও দুঃখ-কষ্ট ভুলে গিয়ে নতুন পরিকল্পনা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য নতুন বছরের শুরুর সময়টার গুরুত্ব রয়েছে। মুসলিম হিসেবে হিজরি নববর্ষ উদযাপন কিংবা মুসলিমদের গৌরবের দিনটি পালনের ঐতিহ্য আমাদের সংস্কৃতিতে ব্যাপকতা লাভ করেনি।
মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশেও তেমন গুরুত্ব দিয়ে দিনটি উদযাপন করা হয় না। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত, জাতীয় হিজরি নববর্ষ উদযাপন পরিষদসহ কয়েকটি ইসলামি সংগঠন এদিন রাষ্ট্রীয় ছুটি ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসলেও তা সরকারের উচ্চ পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছছে না। তার চেয়েও বড় কথা, বিষয়টি নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা যায় নি।
অনেকে আমরা জানি না যে, মুসলিমদের নববর্ষ কোন মাসে হয়? আবার কেউ হয়তবা হিজরি বর্ষ গণনার সঠিক ইতিহাস জানেন না! হিজরি সনের তারিখের খবরও রাখেন না। এর প্রতি মানুষ আকর্ষণও অনুভব করেন না। আবার ভিন্নমতও রয়েছে।
হিজরি সনের প্রথম মাস কারবালার ঐতিহাসিক হৃদয় বিদারক ঘটনার অনন্য স্মৃতি বহন করে চলেছে। মুসলিম বিশ্বে মহরম মাসকে শোকের মাস হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়। এ মাসের ১০ তারিখ কারবালা ময়দানে প্রিয় নবী (দ.) এর প্রিয় দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসেন (রা.) সহ অসংখ্য সাহাবায়ে কেরাম শাহাদাতের সুধা পান করেছেন নির্মম ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে। তাই শোকের এ মাসটির শুরুতে অনেকেই আনন্দ উৎসব উদযাপন করাকে ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক বলেও মনে করেন।
তবে অন্যায়, অসত্য ও স্বৈরাচারের কাছে মাথানত না করে ইমাম হোসাইন (রা.) সহযোগীদের নিয়ে কারবালার শিক্ষাই মুসলমানদেরকে যুগে যুগে অন্যায়, অসত্য ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে উৎসাহ যোগায়। এ কারণেই বলা হয়ে থাকে ‘ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায় হার কারবালা কি বাদ’।
হিজরি নববর্ষ ইসলামি সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্যঅংশ, যা ইতিহাসের গৌরব, ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা ও আত্মিক উন্নয়নের মূর্খ প্রতীক। এটি আমাদেরকে শুধুমাত্র অতীত স্মরণে থেমে থাকতে বলে না, বরং একটি উন্নত ও মূল্যভিত্তিক ইসলামি ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানায়। হিজরি নববর্ষ যেন আমাদের জীবনে হয় নতুন সূর্যোদয়ের অনাবিল বার্তা, আলোকিত পথচলার অনন্য উৎস।
ইসলামি সংস্কৃতি লালনে এবং মুসলিম সমাজে ইসলামি সংস্কৃতি পালনে উদ্ধুদ্ধ করে দৃঢ় কর্তব্য পালন করি এবং বিকৃতি আবেদনময়ী অপসংস্কৃতির দৌরাত্মের বিপরীতে নির্মল জাতীয় চেতনামণ্ডিত ইসলামি সংস্কৃতির প্রাবহ ছড়িয়ে দিতে এবং হিজরি নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর মধ্য দিয়ে আসুন হানাহানি- বিদ্বেষ-বিভেদ ভুলে হিজরি নতুন বছরে নতুন স্বপ্নে ও অঙ্গীকারে সবাই ঘুরে দাঁড়াই।
সোর্স: যুগান্তর
মন্তব্য করুন: