[email protected] শুক্রবার, ৩১ অক্টোবর ২০২৫
১৬ কার্তিক ১৪৩২

তবে কি যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ? নাকি শুধুই মনস্তাত্ত্বিক বিপ্লব?

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ২৭ অক্টোবর ২০২৫ ১৯:১০ পিএম

ছবি : সংগৃহীত

অক্টোবরের রাত লালমনিরহাটের আকাশে তখন অন্ধকার নেমেছে অথচ কোন চাঁদ নেই কোন তারা নেই। নীরবতা এমন রকম যেন পাখির ডাকও গলায় আটকে গেছে; দূর থেকে শুধু সামরিক হেলিকপ্টারের গর্জন শোনা যাচ্ছে। এদিন সকালবেলায় একটি কালো রঙের এসইউভি থামে লালমনিরহাট বিমান ঘাটির গেটে। নেমে আসেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বড় নেতাদের একজন।

সঙ্গে তিনজন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা—কোনও সাংবাদিক নেই, কোনও ক্যামেরা নেই; কেবল অন্ধকার আর বিষণ্ণ বাতাস। এই রাতটি শুধু একটি পরিদর্শন হিসেবেই নয়—দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে শুরু হওয়া নিঃশব্দ একটি ঝড়ের প্রথম সুর মনে হচ্ছিলো, এবং তার কেন্দ্রবিন্দু এখন লালমনিরহাট। ১৯৬০ দশকে পাকিস্তানি আমলে নির্মিত এই বিমানঘাটি একসময় গৌরবের প্রতীক ছিল; ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পর এটি তৎকালীনভাবে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয় এবং পাঁচ দশক ধরে এটি নিস্তরঙ্গ এক ভূখন্ড হিসেবে রয়ে যায়—ঘাস গজায়, ঝিঝি ডেকে। কিন্তু ২০২৫ সালে এসে লালমনিরহাট যেন ঘুমন্ত দৈত্যের মতো জেগে উঠেছে: শুধু রানওয়ে পুনর্গঠন হচ্ছে না, বরং নির্মাণ চলছে ভূগর্ভস্থ কমান্ড সেন্টার, বসানো হচ্ছে নতুন জেনারেশন রাডার ইউনিট, তৈরি হচ্ছে ফাইটার জেট সংরক্ষণের জন্য হ্যাঙ্গার সিস্টেম — এবং সবই ঘটছে এমন জায়গায় যা কেবল বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে নয়, বরং অবস্থান করছে সরাসরি ভারতের শিলিগুড়ি করিডরের মুখে; সেই করিডরটি ভারতের মূল ভূখণ্ডকে উত্তরপূর্বের সাতটি রাজ্যের সঙ্গে সংযুক্ত রাখে এবং মাত্র ২২ কিলোমিটার চওড়া এই করিডর বিচ্ছিন্ন হলে ভারতের জন্য তা দারুণ অসুবিধার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

 

বাংলাদেশ ওয়ার প্ল্যান নিয়ার ইন্ডিয়াস চিকেন নেক। শিরোনামটি ভারতের চ্যানেল ডিএনএর। তারা বলছে বাংলাদেশ পাকিস্তান ও চীনের সহায়তায় লালমনিরহাটের যুদ্ধঘাটি বানাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে তথ্য প্রমাণ কোথায়? বাংলাদেশ এখনো জেএফ-৭ কেনেনি; বরং চীনের জে-১০ সি নিয়ে আলোচনা চলছে, কোনো পাকিস্তানি ফার্মের উপস্থিতি নিশ্চিত নয়; তবুও মিডিয়া নানা রকম দাবি ছড়িয়ে দিচ্ছে যেন যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। এ নাটকীয়তার প্রেক্ষিতে বিশ্লেষক অভিষেক তত্ত্ব জানান, ভারতের এই 'ইনভেশন অফ থ্রেট' মূলত ডোমেস্টিক ডিসট্র্যাকশন কৌশলের অংশ—অভ্যন্তরীণ সংকট ভুলে থাকতে জনগণকে সীমান্ত উত্তেজনায় ব্যস্ত রাখা হচ্ছে।

 

ভারতের 15 টি এয়ারবেস ঘিরে রেখেছে বাংলাদেশকে। বিশেষ করে হাসিমারা 85 কিলোমিটার, বাগডোগরা 25 মিনিটের দূরত্ব, কেলাসনগর 100 কিলোমিটার, রাফাল, সুখই সবই মোতায়েন। এই ত্রিমুখী মোচর ভারতকে বাহ্যিকভাবে শক্তিশালী মনে করালেও বিশ্লেষক অভিষেক তত্ত্ব বলছেন, এই সংখ্যাগুলো শুধু ভয় দেখাতে পারে। কিন্তু ব্যবস্থাপনাগতভাবেই নিজেকেই দুর্বল করে তোলে। লালমনিরহাটে হওয়া উন্নয়ন কেবল সামরিক নয়—এটি রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক একটি বার্তাও বহন করছে; দীর্ঘদিন বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা নীতি ছিল প্রতিক্রিয়াশীল—আক্রমণ ঘটলে প্রতিরোধ করা হবে—কিন্তু এখন নীতিতে পরিবর্তন এসেছে: প্রস্তুত থাকো যাতে কেউ আক্রমণের সাহস না পায়—এই কৌশলকে বলা হচ্ছে deterrence by displacement—হুমকির সামনে দাঁড়িয়ে না থেকে হুমকিকে মোকাবিলা করার মনোভাব। আর তাই লালমনিরহাটে নতুন প্রজন্মের সামরিক অবকাঠামো নির্মাণ হচ্ছে, যা চুপচাপ থেকেই বার্তা দিচ্ছে—“তুমি যদি আমাকে ঘিরে ফেলো, আমি সীমানা চুপচাপ রেখে বসে থাকবো না।” ভারত দাবি করে তাদের সামর্থ্য আছে ১৫ মিনিটে বাংলাদেশের কোনো ঘাটি ধ্বংস করার; তবু প্রশ্ন উঠছে—কেন ভারত উদ্বিগ্ন? কারণ বাংলাদেশ এখন কারো একক উৎসের উপর নির্ভর করছে না; চীন ও তুরস্কের সঙ্গে ডিফেন্স ডিল করা ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও ভারসাম্য বজায় রেখে চলছে; জে-১০ সি, স্নাইপার এফএম-৯০, এইচকিউ-৬ ইত্যাদি এবং একইসাথে সাইবার ওয়ারফেয়ারের নতুন কম্যান্ড তৈরির খবর আছে—এগুলি স্পষ্ট করে যে বাংলাদেশ কেবল আকাশ প্রতিরক্ষা নয়, সমগ্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাই পুনর্গঠনের পথে। বিশ্লেষক ডক্টর আরিফুর রহমানের মতে, যে দেশ প্রতিরক্ষা নীতিকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদার অংশ বানায়, তাকে হুমকি দিয়ে আটকানো যায় না; বাংলাদেশ এখন তিন স্তরে প্রতিরক্ষা করছে—আকাশ প্রতিরক্ষা, সাইবার ওয়ারফেয়ার ও আঞ্চলিক ঘাঁটি—কক্সবাজার, বরিশাল, লালমনিরহাট—এ তিন স্তরের সংযুক্তি তৈরি করছে এক ইন্টিগ্রেটেড শিল্ড, যার ফলে কোনো বহিরাগত সহজে আঘাত হানতে পারবে না। এটা যুদ্ধের প্রস্তুতি নয়, বরং আত্মরক্ষার মানসিকতা।

 

রাত গভীর, লালমনিরহাট ক্যান্টনমেন্টে আলো কমানো—শুধু সাদা বাতি জ্বলছে প্রহরার টাওয়ারে; এক কালো ট্র্যাক ঘাটের পশ্চিম গেটে প্রবেশ করে, পেছনে মোটা ক্যানভাসে ঢাকা কিছু বস্তু—রাডার ইউনিট, ড্রোন সাপোর্ট নাকি গাইডেড মিসাইল—কেউ জানে না। ঘাঁটির ভেতরে থাকা সেনারা মুখ বন্ধ। প্রহরীরা জানে এই ট্রাকের গন্তব্য হ্যাঙ্গারের নিচে সাবটেরিনিয়ন বাংকারে। গ্রামের চায়ের দোকানে মানুষ ফিসফিস করে বলছে “এবার কিছু একটা হবে” কেউ আবার বলছে “যুদ্ধ না, কূটনীতি”—তবে বাতাস যেন ফিসফিস করে জানাচ্ছে, নীরবতা মানে দুর্বলতা নয়, বরং প্রস্তুতির আরেক নাম। লালমনিরহাট আজ কেবল প্রতিরক্ষার প্রতীক নয়; এটি মনস্তাত্ত্বিক আত্মরক্ষার ঘোষণা—প্রতিটি বুটের শব্দ, প্রতিটি রাডার সিগনাল, প্রতিটি ড্রোন উড্ডয়ন একটি বার্তা দেয়: আমরা প্রস্তুত; আকাশে যদি সংঘাত শুরু হয়, নিচে আমরা আমাদের কূটনীতি ও সাহস দিয়ে কাউন্টডাউন শেষ করব—এখন সেই কাউন্টডাউন হয়ত ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে।

মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর