 
                                                                        
                                    রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) শিক্ষার্থী ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আবু সাঈদ ছররা গুলির আঘাতে রক্তক্ষরণে মারা গেছেন বলে জানিয়েছেন ফরেনসিক চিকিৎসক।
রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) শিক্ষার্থী ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আবু সাঈদ ছররা গুলির আঘাতে রক্তক্ষরণে মারা গেছেন বলে জানিয়েছেন ফরেনসিক চিকিৎসক। আবু সাঈদের লাশের ময়নাতদন্ত করেছেন রংপুর মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সহকারী অধ্যাপক রাজিবুল ইসলাম। অবশেষে সাঈদের মৃত্যু ও প্রতিবেদনের বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন তিনি।
৩১ অক্টোবর, বৃহস্পতিবার দুপুরে রংপুর মেডিক্যাল কলেজের নিজ কক্ষের সামনে এসব তথ্য জানান অধ্যাপক রাজিবুল।
আবু সাঈদের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন তৈরি নিয়ে সর্বোচ্চ চাপের মুখে ছিলাম জানিয়ে অধ্যাপক রাজিবুল বলেন, ‘মিথ্যা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দিতে আমাকে কতভাবে চাপ ও ক্ষমতার দাপট দেখানো হয়েছে, তা বলে বোঝানো যাবে না। এটি ছিল একজন চিকিৎসকের জন্য মারাত্মক মানসিক চাপ এবং হয়রানি। শেষমেশ বড় অঙ্কের অর্থ দিয়ে সিঙ্গাপুরে পরিবারসহ ভ্রমণে পাঠানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল।’
তিনি বলেন, ‘মিথ্যা তথ্য দিয়ে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করতে বলা হয়েছিল। ছয়বার এই প্রতিবেদন পরিবর্তন করতে বাধ্য করেছিল পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা। আমাকে বলা হয়েছিল, পুলিশের গুলিতে নয়; মাথায় আঘাতজনিত কারণে আবু সাঈদের মৃত্যু হয়েছে মর্মে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য। এভাবে প্রতিবেদন তৈরির জন্য পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তা, এমনকি ওপর মহল থেকেও নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল। এত চাপের মাঝেও আমি সঠিক তথ্য দিয়ে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করেছিলাম। এরপর রংপুর মহানগর পুলিশের পাঁচ-ছয় জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, গোয়েন্দা সংস্থা, ডিজিএফআই কর্মকর্তাদের দিয়ে আমাকে চাপে রাখা হয়েছিল। যেকোনোভাবে প্রতিবেদন পরিবর্তনের কথা বলেছিলেন তারা। ওই সময় মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ শাহ মো. সরওয়ার জাহান ছুটিতে ঢাকায় ছিলেন।’
তিনি বলেন, ‘রংপুর মহানগর পুলিশের উচ্চপদস্থ কয়েকজন কর্মকর্তা সার্বক্ষণিক আমার কক্ষে এসে বসে থাকতেন। নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করতেন। তারা আমাকে বলতেন, মাথায় আঘাতজনিত কারণে সাঈদের মৃত্যু হয়েছে মর্মে প্রতিবেদন দেন। আমি তাদের বলেছি, নৈতিকতা-বিচ্যুত হতে পারবো না। অন্য কোথাও আবার তদন্ত করলে আমার প্রতিবেদন ভুল প্রমাণিত হবে। তখন আমি বিপদে পড়বো। এর মাঝে একদিন এক পুলিশ কর্মকর্তা আমাকে বড় অঙ্কের অর্থ দিয়ে সিঙ্গাপুরে পরিবারসহ ভ্রমণে পাঠানোর প্রস্তাব দেন। বলেছিল, সব টাকা পুলিশ প্রশাসন দেবে। কিন্তু আমি প্রস্তাবে রাজি হইনি। কারণ ময়নাতদন্ত করতে গিয়ে দেখেছি, গুলিতে ছেলেটার বুক ও শরীর ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল। আমি শুরুতেই প্রতিবেদনে তা-ই উল্লেখ করেছি।’
অধ্যাপক রাজিবুল আরও বলেন, ‘পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের চাপে কাজ না হওয়ায় স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) নেতা ডা. চন্দন ও স্বাচিপের আরও দুই নেতাকে দিয়ে আমাকে চাপ দেওয়া হয়েছিল। তাদের চাপে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন ছয়বার পরিবর্তন করতে হয়েছিল। তারপরও তাদের মনমতো হয়নি। তারা চেয়েছেন আমি যেন হেড ইনজুরি দেখিয়ে দিই। নিউরোজেনিক শক দেখিয়ে দিই। তখন কলেজের অধ্যক্ষ আমাকে বলেছিলেন মৃত্যুর সঠিক প্রতিবেদন দিতে। কারও চাপে যেন নতি স্বীকার না করি। শেষে আমি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছি, দ্য ডেথ ওয়াজ ডিউ টু এভোব মেনশনড ইনজুরিস, হুইচ ওয়াজ অ্যান্টিমোর্টেম অ্যান্ড হোমিসাইডাল।’
এটি উল্লেখ করার কারণ হিসেবে অধ্যাপক রাজিবুল বলেন, ‘হোমিসাইডালের একটা ব্যাপার আছে, তা হলো হেড ইনজুরি হলে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ থাকে। ইন্ট্রাসেরিব্রাল হেমোরেজ থাকে, ফ্র্যাকচার থাকে। আবু সাঈদের ক্ষেত্রে এসবের কোনোটিই ছিল না। আমাকে মানসিকভাবে প্রচণ্ড চাপে রেখে প্রতিবেদন বদল করেছিল তারা। অবশেষে এও বলা হয়েছিল, আমার নামে গোয়েন্দা রিপোর্ট হয়ে গেছে। ঢাকা থেকে আমাকে হুমকি দেওয়া হয়েছিল সরকারি চাকরি করে কীভাবে সরকারের বিপক্ষে রিপোর্ট দিচ্ছেন?।’
তিনি বলেন, ‘আসলে আবু সাঈদ গুলিতেই মারা গেছেন। তার মাথায় কোনও আঘাত ছিল না। আমি একটি আঘাতও দেখিও নাই মাথায়। এটাই সত্যি। পুলিশ ও প্রশাসন চেয়েছিল, মাথায় আঘাতের কারণ উল্লেখ করে প্রতিবেদন দিলে তারা বেঁচে যাবে। কিন্তু একজন চিকিৎসক হিসেবে আমি এটি করতে পারি না।’
পুলিশের কোন কোন কর্মকর্তা হুমকি দিয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি তাদের কারও নাম বলতে চাচ্ছি না।’
ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করা এক চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, ‘আবু সাঈদ নিহত হওয়ার পর থেকে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পরিবর্তন করার জন্য পুলিশ ও প্রশাসনের বিভিন্ন জনকে দিয়ে ধারাবাহিকভাবে চাপ দিয়েছিল পুলিশ। এর মধ্যে কয়েকজনকে আমি চিনি। তারা হলেন মহানগরের উপপুলিশ কমিশনার (অপরাধ) মো. আবু মারুফ হোসেন, সহকারী পুলিশ কমিশনার (কোতোয়ালি জোন) মো. আরিফুজ্জামান এবং দাড়িওয়ালা এক পুলিশ কর্মকর্তা। বাকিদের নাম জানি না।’
গত ১৬ জুলাই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নম্বর ফটকে পুলিশের গুলিতে নিহত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন।
গত ১৮ জুলাই নিহত আবু সাঈদের বড় ভাই রমজান আলী বাদী হয়ে ১৭ জনের নামোল্লেখ এবং অজ্ঞাত আরও ১৩০-১৩৫ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেন। এই মামলায় পুলিশের রংপুর রেঞ্জের সাবেক উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) আবদুল বাতেন, মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার মো. মনিরুজ্জামান, সহকারী কমিশনার আরিফুজ্জামান ও আল ইমরান হোসেন, উপকমিশনার আবু মারুফ হোসেন, তাজহাট থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রবিউল ইসলাম ও এসআই বিভূতিভূষণকে এজাহারনামীয় আসামি করা হয়।
মন্তব্য করুন: