[email protected] বৃহঃস্পতিবার, ১ মে ২০২৫
১৮ বৈশাখ ১৪৩২

পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধে ভারতীয়দের কান্না!

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ০৮ এপ্রিল ২০২৫ ১৭:০৪ পিএম

সংগৃহীত

শুল্ক তুলে দিয়েও বাংলাদেশে পেঁয়াজ রপ্তানি করতে পারছে না ভারত। সময়মতো বিক্রি করতে না পেরে ভারতে বিপুল পরিমাণ পেঁয়াজ পচে যাচ্ছে। এতে বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে সেখানকার কৃষক ও ব্যবসায়ীরা। এ নিয়ে ভারতজুড়ে চরম হাহাকার সৃষ্টি হয়েছে।

এ পরিণতির জন্য দেশটির মোদি সরকারের বৈদেশিক নীতি, ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতা শুভেন্দু অধিকারী ও রিপাবলিক বাংলার বিতর্কিত সাংবাদিক ময়ূখ রঞ্জন ঘোষকে দায়ী করছেন সেখানকার ব্যবসায়ী ও কৃষকরা। সম্প্রতি ময়ূখ রঞ্জন ঘোষের বাড়ি ঘেরাওয়ের ঘটনাও ঘটেছে বলে জানা গেছে।

ভারতীয় কৃষকদের মতে, ময়ূখ রঞ্জনের মিথ্যা প্রচারণার কারণে দুই দেশের মধ্যে ব্যবসায়িক সম্পর্ক খারাপ হয়েছে এবং রপ্তানি বন্ধ হয়ে গেছে। ভারতের গ্রামীণ অর্থনীতি ইতোমধ্যেই কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন, আর এই রপ্তানি বন্ধের ফলে কৃষকদের জীবন আরো দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। কিছু কৃষক পণ্য বিক্রি করতে না পেরে আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হচ্ছেন- এমন খবরও পাওয়া যাচ্ছে।

এমন পরিস্থিতির পেছনে মিডিয়ার একটি বড় ভূমিকাও রয়েছে। বিশেষত রিপাবলিক বাংলা টিভির সাংবাদিক ময়ূখ রঞ্জন বাংলাদেশ সম্পর্কে মিথ্যা প্রচারণা চালানোর জন্য অভিযুক্ত হচ্ছেন। এর আগে ময়ূখ রঞ্জন দাবি করেন, বাংলাদেশে বিশৃঙ্খলা চলছে এবং ভারতীয় পণ্য আমদানি বন্ধ হলে বাংলাদেশে খাদ্য সংকট দেখা দেবে। এ ধরনের ভুল তথ্য ছড়ানোর জন্য কৃষকরা ময়ূখ রঞ্জনকে দায়ী করে তার বাড়ি ঘেরাও করেন এবং বাড়ির সামনে পেঁয়াজ ও আলু ফেলে বিক্ষোভ প্রদর্শন করছেন বলে জানা গেছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এ দুর্দশার জন্য সরকারের নীতিগত ব্যর্থতা এবং মিডিয়ার অপপ্রচার দায়ী। এই সংকটের মধ্যেও বাংলাদেশ কিছুটা স্বস্তিতে রয়েছে; কারণ তারা বিকল্প উৎস থেকে পণ্য আমদানির ব্যবস্থা করেছে। এর ফলে তাদের বাজারে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা সম্ভব হয়েছে।

পেঁয়াজ নিয়ে ভারতীয় কৃষকদের ক্ষোভের মুখে পড়েছেন বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারীও। তার বিতর্কিত মন্তব্যের জেরে রপ্তানি বন্ধের ঘটনায় বাস্তায় আলু ও পেঁয়াজ ফেলে প্রতিবাদও করেছেন তারা। এর আগে সংখ্যালঘু ইস্যুতে ভারত থেকে বাংলাদেশে আলু ও পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের হুমকি দিয়েছিলেন বিজেপির এই নেতা।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও মহারাষ্ট্রসহ বিভিন্ন রাজ্যে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ার কারণে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এই পরিস্থিতি ক্রমেই তীব্র হচ্ছে। ভারতের কৃষকরা অভিযোগ করছেন, তারা পেঁয়াজ ও আলু যে দামে বিক্রি করছেন, তাতে উৎপাদন খরচও উঠছে না। এ পরিস্থিতিতে কৃষকরা রাস্তায় পেঁয়াজ ও আলু ফেলে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। আলু-পেঁয়াজ নিয়ে বিজেপি নেতা শুভেন্দুর বিতর্কিত বক্তব্যও এর পেছনে দায়ী বলে মনে করছেন তারা।

আমদানিকারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত বছরের শেষদিকে হঠাৎ ভারতীয় পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি ও শুল্কারোপ করায় আমদানিকারকরা ডিসেম্বর থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ রাখেন। চলতি মৌসুমে ভারতে পেঁয়াজের বাম্পার ফলন হওয়ায় মজুত বেড়েছে বহুগুণ। কিন্তু ভারতীয় পেঁয়াজের বড় বাজার বাংলাদেশ হলেও আমদানি বন্ধ থাকায় চরম বিপাকে পড়েছে ভারত।

এরই প্রেক্ষিতে গত ২২ মার্চ পেঁয়াজ রপ্তানি থেকে শুল্ক তুলে নিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে ভারতের রাজস্ব বিভাগ। এতে ১ এপ্রিল থেকে ভারতের রপ্তানিকারকরা বিনা শুল্কে পেঁয়াজ রপ্তানি করতে পারবেন। এতদিন পেঁয়াজ রপ্তানিতে ২০ শতাংশ শুল্ক ছিল। মূলত পেঁয়াজের মজুত বেড়ে যাওয়ায় এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয় দেশটি।

কিন্তু বিনা শুল্কে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির সুযোগ বিষয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। এ নিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যেও ভিন্নমত রয়েছে। সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলোও বলছে, এ মুহূর্তে ভারত থেকে পেঁয়াজের আমদানির অনুমতি নিয়ে সরকারও গভীরভাবে ভাবছে।

এর আগে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে ভারত পেঁয়াজ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়। পরে আন্দোলনের মুখে শর্তসাপেক্ষে ২০২৪ সালের ৪ মে পেঁয়াজ রপ্তানির অনুমতি দেয় ভারত। তবে পেঁয়াজ রপ্তানিতে ৪০ শতাংশ রপ্তানি শুল্ক এবং প্রতি টনের ন্যূনতম মূল্য ৫৫০ ডলার ঠিক করে দেয় দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার। গত বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর রপ্তানির ন্যূনতম মূল্য প্রত্যাহার করে শুল্ক কমিয়ে ২০ শতাংশ করে দেওয়া হয়। সর্বশেষ গত ২২ মার্চ পেঁয়াজ রপ্তানিতে পুরোপুরি শুল্ক প্রত্যাহারের কথা জানায়।

এদিকে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি অনুমতির (আইপি) মেয়াদ শেষ হয়েছে গত ৩১ মার্চ। ভারত থেকে নতুন করে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেওয়া-না দেওয়া নিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে রয়েছে ভিন্নমত। ব্যবসায়ীদের একটি বড় অংশ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা আর ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি করবেন না। বছরের শেষদিকে আমদানি যদি করতেই হয়, তবে অন্য দেশ থেকে করা যাবে। অন্য একটি অংশ বলছে, বিনা শুল্কে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির সুযোগ কাজে লাগানো যেতে পারে। এতে পেঁয়াজের সংকট হবে না।

কিছুদিন আগেও ভারত থেকে আমদানি করা প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম পড়ছিল ৪১ থেকে ৪২ টাকা। শুল্ক প্রত্যাহার করায় ২৫ থেকে ৩০ টাকায় প্রতি কেজি পেঁয়াজ আমদানি করা যাবে। আর বাজারে এখন প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা।

তবে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ থাকায় দেশি পেঁয়াজের ওপর চাপ বাড়ায় সপ্তাহের ব্যবধানে বাজারে কেজি প্রতিতে ৫ থেকে ১০ টাকা দাম বেড়ে ৩৫ থেকে ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ মধ্য রমজানেও বিক্রি হয়েছে ২৭ থেকে ৩৩ টাকা কেজি। দাম আরো বাড়তে পারে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, গুণমানে সেরা হালি পেঁয়াজ বাজার দখল করেছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে পেঁয়াজের দামও কম। তবে বর্তমানে যে দাম চলছে, তাতে কৃষকও বাঁচবে, ক্রেতারাও ঠকবেন না।

ব্যবসায়ীদের দাবি, ভারত বাংলাদেশের বাজার দখল করতে পেঁয়াজ রপ্তানিতে শুল্ক কমিয়েছে। কিন্তু তাতেও ব্যর্থ হয়েছে। আর এতে কৃষকরা ক্ষতি পুষিয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। কেননা, এ বছর এক কেজি পেঁয়াজ উৎপাদনে খরচ হয়েছে ৩৮ থেকে ৪০ টাকা।

পাবনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আশিকুর রহমান বলেন, এ বছর কেজিপ্রতি পেঁয়াজ উৎপাদনে খরচ পড়েছে ৩৮ টাকা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বিগত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে ৩৭ লাখ ৯০ হাজার টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ৩৮ লাখ ২১ হাজার টন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে মন্ত্রণালয়। তবে উৎপাদনে টার্গেট ছাড়িয়ে যাবে বলে কৃষি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

বিগত সময়ে বাজারে ভারতীয় পেঁয়াজের আগ্রাসনে কোণঠাসা থাকত দেশি জাতের পেঁয়াজ। তবে এবারের চিত্র পুরোটাই ভিন্ন। দাম আর মানের কারণে হালি পেঁয়াজ জায়গা করে নিয়েছে দেশের বৃহৎ পাইকারি বাজার দিনাজপুরের হিলি, চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ ও চাক্তাইয়ের আড়তগুলোতে।

২৭ মার্চ অবসরে যাওয়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরিচালক (ক্রপস উইং) শওকত ওসমান বলেন, দেশে এবার পেঁয়াজের বাম্পার হয়েছে। বীজসহ পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে ৩৯ লাখ টন। কিন্তু এবার উৎপাদনে টার্গেট ছাড়িয়ে যাবে। ফলে মৌসুমের শুরুতেই পেঁয়াজ সংরক্ষণের ওপর গুরুত্বারোপ করতে পারলে আমাদের আর পেঁয়াজ আমদানি করতে হবে না। যদি বছরের শেষদিকে কিছু আমদানি করতেই হয়, তবে পাকিস্তান ও মিসর থেকে করা যেতে পারে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন বলেন, ‘ভারত বিনাশুল্কে পেঁয়াজ রপ্তানির সুযোগ দিয়েছে তাদের পলিসি অনুসারে। বর্তমানে আমাদের পলিসি হওয়া উচিত ভারত থেকে পণ্য আমদানিকে নিরুৎসাহিত করা। এতে আমাদের কৃষক লাভবান হবেন। তারা চাষাবাদে উৎসাহিত হবেন। আর দেশি পেঁয়াজে চাপ বাড়লে দাম অনেক বেড়ে যাবে- এমনটা মনে করছি না। কারণ, এখন ভরা মৌসুম চলছে। দেশি পেঁয়াজ শেষ হলে তখন বিকল্প চিন্তা করা যেতে পারে।

সোর্স: আমার দেশ



মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর