[email protected] শনিবার, ১৭ মে ২০২৫
৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

শীর্ষ ১০ গ্রুপেরই খেলাপি ঋণ ৫৪ হাজার কোটি টাকা

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৭ মে ২০২৫ ১৮:০৫ পিএম
আপডেট: ১৭ মে ২০২৫ ৬:৩৪ পিএম

গ্রাফিক্স

পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে অনিয়ম ও জালিয়াতির মাধ্যমে যেসব ঋণ দেওয়া হয়েছিল, তা একে একে খেলাপি হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি দেড় দশক ধরে খেলাপি না থাকা বেক্সিমকো ও এস আলম গ্রুপ এক লাফে চলে এসেছে তালিকার শীর্ষে।

ব্যাংক খাতে বর্তমানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১০০ কোটি টাকার ওপরে রয়েছে এমন খেলাপি ঋণ প্রায় এক লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা, যা মোট খেলাপির ৫৭ দশমিক ৪৫ শতাংশ। এর মধ্যে শীর্ষ ১০ গ্রুপেরই খেলাপি ঋণ প্রায় ৫৪ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক বিশেষ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

ব্যাংক কর্মকর্তারা বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বেশ কিছু গ্রুপকে যেভাবে খুশি ঋণ বের করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। তারা ক্ষমতার এতটাই চূড়ায় ছিল যে, ঋণের টাকা চাওয়ার সাহসও পাননি কোনো ব্যাংক কর্মকর্তা। আবার ওই সময় এসব ঋণ খেলাপি হলেও তা নিয়মিত হিসেবে দেখানো হয়েছিল। বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এসব ঋণ খেলাপি করে দিচ্ছে। তাই শীর্ষ গ্রুপগুলোর খেলাপি ঋণ বাড়ছে। তবে এসব ঋণ আদায়ে কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ১০০ কোটির ওপরে খেলাপি ঋণ ছিল এক লাখ ৪৭ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। ডিসেম্বর শেষে তা বেড়ে হয়েছে এক লাখ ৬৩ হাজার ৭২৫ কোটি টাকা। তিন মাসে বেড়েছে ১৬ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচ ব্যাংকের ১০০ কোটির ওপরে খেলাপি ঋণ ৯২ হাজার ৭৯১ কোটি টাকা, যা খেলাপি ঋণের ৬৭ দশমিক ৯২ শতাংশ। বেসরকারি ২৯ ব্যাংকের ৬৯ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা বা ৪৬ দশমিক ৫৭ শতাংশ। বিদেশি দুটি ব্যাংকের ৩২৯ কোটি টাকা বা ১২ দশমিক ১৯ শতাংশ। এ ছাড়া বিশেষায়িত একটি ব্যাংকের ৮৩৭ কোটি টাকা বা মোট খেলাপি ঋণের ১৩ শতাংশ।

ঋণের টাকা আদায় না হওয়ার কারণে পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান। তিনি বলেন, ‘১০০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ বাড়ছে; কারণ এই ঋণ আদায় হচ্ছে না। বকেয়া ঋণ পরিশোধ না হলে সুদ যোগ হয়ে স্থিতি বাড়তেই থাকে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে মুজেরী বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিগত সরকারের আমলে বাণিজ্যিক ব্যাংক ও সুবিধাভোগীদের ছত্রছায়ায় ঋণখেলাপির কালচার গড়ে তুলেছে। ওই সময় ঋণ পুনঃতফসিল ও সুদ মওকুফসহ নানা সুবিধা দেওয়া হয়েছে। ফলে একটা ভঙ্গুর ব্যাংকব্যবস্থা দেখতে পাচ্ছি। বর্তমান সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশা ছিল, যেসব কারণে ব্যাংকগুলোর ভঙ্গুর অবস্থা তৈরি হয়েছে, সে ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নেবে। যাতে ব্যাংকগুলো ঋণখেলাপির সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। কিন্তু বাস্তবে সে ধরনের কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।’

মোস্তফা কে মুজেরী বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত ছিল কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া। কঠোর পদক্ষেপ নিলে ভবিষ্যতে খেলাপি ঋণ হওয়ার প্রবণতা কমে যেত।’

শীর্ষ ১০ গ্রুপের খেলাপি ঋণ ৫৪ হাজার কোটি টাকা

ব্যাংক খাতে ১০০ কোটি টাকার ওপরে শীর্ষ ১০ গ্রুপের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫৩ হাজার ৭৪৯ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর শেষে যা ছিল ৫১ হাজার ৮৫৭ কোটি টাকা। তিন মাসে বেড়েছে এক হাজার ৮৯২ কোটি টাকা। সরকারের পালাবদলের পর ব্যাংক খাতের গোপন অনেক বোঝাপড়া প্রকাশ্যে আসতে শুরু করলে ঋণখেলাপির তালিকাতেও বিস্তর ওলটপালট হয়েছে। দেড় দশক ধরে খেলাপি না থাকা বেক্সিমকো এবং এস আলম গ্রুপ এক লাফে চলে এসেছে তালিকার শীর্ষে। শীর্ষ ১০-এর মধ্যে কয়েকটির আগে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হলেও দেশের ব্যবসায়িক জগতে অল্প পরিচিত তিনটি কোম্পানির নাম তালিকার ওপরের দিকে দেখে বিস্ময় জাগছে অনেকের। কারণ, ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে সংসদে আগের সরকারের আমলে প্রকাশ করা শীর্ষ ২০ খেলাপির তালিকায় বেক্সিমকো ও এস আলমসহ এর ৬ গ্রুপের নামই ছিল না।

ঋণখেলাপির শীর্ষে থাকা ১০ গ্রুপ হলো : বেক্সিমকো, এস আলম, এনোনটেক্স, ক্রিসেন্ট, এফএমসি, রতনপুর, জাকিয়া কটন টেক্স, রাঙ্কা, রিমেক্স ফুটওয়্যার ও জাজ ভূইয়া। এসব গ্রুপকে বাছবিচারহীনভাবে ঋণ দেওয়া ব্যাংকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উদার ছিল জনতা ব্যাংক। কারণ, ব্যাংকটিতে শীর্ষ ১০-এর মধ্যে ছয়টি গ্রুপের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৪৩ হাজার ৫৫ কোটি টাকা। এর ফলে সরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে এক সময় ভালোর কাতারে থাকা ব্যাংকটির খোলস উন্মোচিত হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র বলেন, ‘ঋণ পরিশোধ কীভাবে করা যায়, তা নিয়ে আলোচনায় আসছে না শীর্ষ গ্রুপগুলো। কারণ, তাদের অনেককে দেশেই পাওয়া যাচ্ছে না। আবার অনেকে ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন। ঋণ পরিশোধে আগ্রহীও নয় তারা। এসব গ্রুপ ব্যাংকের কাছে কোনো প্রস্তাব নিয়েও আসছে না।’

তার মতে, এসব ঘটনা থেকে কীভাবে উত্তরণ মিলবে সেসব মাথায় রেখে নতুন ব্যাংক রেজুলেশন আইন করা হয়েছে। ভবিষ্যতে যাতে রাজনৈতিক সরকার এসে আগের সরকারের মতো আচরণ করার সুযোগ না পায়, সে জন্যই এই উদ্যোগ।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, বেক্সিমকো গ্রুপের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২১ হাজার ৪৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে জনতা ব্যাংকে ১৯ হাজার ৩৭২ কোটি এবং সোনালী ব্যাংকে দুই হাজার ৪৬২ কোটি টাকা। ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের সময়কার সুবিধাভোগী হিসেবে আলোচিত তার শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান। সালমান বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান খুলে নামে-বেনামে ২৩টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। সালমান রহমান গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে গেলে ব্যাংকগুলো ওই শিল্পগোষ্ঠীর নামে এবং সুবিধাভোগী হিসেবে বিভিন্ন নামের কোম্পানি খুলে নেওয়া ঋণকে খেলাপি হিসেবে দেখিয়েছে। এখন এসব ঋণ আদায় নিয়ে জটিলতায় পড়েছে ব্যাংকগুলো।

এ বিষয়ে জানতে জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মজিবর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে সোনালী ব্যাংকের এমডি শওকত আলী খান বলেন, বেক্সিমকোর ঋণ আদায়ে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে কাজ শুরু হয়ে গেছে।

দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণ এস আলম গ্রুপের। তাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১১ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে জনতা ব্যাংকে ৯ হাজার ৩৮৯ কোটি এবং ইউনিয়ন ব্যাংকে দুই হাজার ৪৬২ কোটি টাকা। এস আলম ১১টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে সোয়া দুই লাখ কোটি টাকা ঋণ নামে-বেনামে বের করে নিয়েছেন। ব্যাংকগুলোতে অডিট কার্যক্রম চলমান থাকায় এসব ঋণ এখনো খেলাপির খাতায় যুক্ত হয়নি। এস আলম গ্রুপের কর্ণধার চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম মাসুদ শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ ছিলেন।

তৃতীয় সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণ এনোনটেক্স গ্রুপের। তাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭ হাজার ৭০৮ কোটি টাকা, যার খেলাপি ঋণের পুরোটাই জনতা ব্যাংকে। গ্রুপটির কর্ণধার ইউনুছ বাদল। জনতা ব্যাংক এই গ্রুপকে ঋণের অর্ধেক পরিশোধের শর্তে বাকি সুদ মওকুফ করে দেয়। কিন্তু ঋণের অর্ধেক সুদ মওকুফ করেও ঋণ আদায় করতে পারেনি। ফলে পুনরায় ঋণগুলো খেলাপি হয়ে যায়।

চামড়া খাতের আলোচিত ক্রিসেন্ট গ্রুপ খেলাপি ঋণের শীর্ষ চারে আছে। তাদের খেলাপি ঋণ ৩ হাজার ৫১ কোটি টাকা, যার পুরোটাই জনতা ব্যাংকের। গ্রুপটির কর্ণধার আবদুল কাদের ও তার ভাই চলচ্চিত্র পরিচালক আবদুল আজিজ। আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদে এই গ্রুপের উত্থান হয় এবং ব্যাংক থেকে বিপুল ঋণ পায় তারা।

আরেক শীর্ষ খেলাপি এফএমসি গ্রুপ। তাদের খেলাপি ঋণ এক হাজার ৪৯৬ কোটি টাকা। গ্রুপের পুরো খেলাপি ঋণ ন্যাশনাল ব্যাংকের। এ বিষয়ে ন্যাশনাল ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত এমডি ইমরান আহমেদ বলেন, ‘এই গ্রুপ বহু আগে থেকেই ঋণখেলাপি। আমাদের রিকভারি পরিকল্পনা হিসেবে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে। কিন্তু তারা ঋণ পরিশোধ করছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত আসার পর তাদের ব্যাপারে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’

চট্টগ্রামের ইস্পাত খাতের অন্যতম শিল্পপ্রতিষ্ঠান রতনপুর গ্রুপ। তাদের খেলাপি ঋণ এক হাজার ২২৭ কোটি টাকা। এ ঋণের পুরোটাই জনতা ব্যাংকের। এ ছাড়া জাকিয়া কটন টেক্সের অগ্রণী ব্যাংকে এক হাজার ২১৪ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি হয়েছে। রিমেক্স ফুটওয়্যারের জনতা ব্যাংকে এক হাজার ১৩৪ কোটি, রাঙ্কা গ্রুপের জনতা ব্যাংকে এক হাজার ১৭৩ কোটি এবং জাজ ভূইয়া গ্রুপের অগ্রণী ব্যাংকে এক হাজার ৯১ টাকার খেলাপি ঋণ রয়েছে।

জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বড় ঋণখেলাপিরা নিজেরাও পালিয়েছেন, সঙ্গে করে টাকাও নিয়ে গেছেন। এসব টাকা দেশে নেই। দেশে যেসব সম্পদ আছে, সেগুলো ক্রোক করে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব। আর বিদেশে যা চলে গেছে, তার জন্য আলাদা টাস্কফোর্স করা হয়েছে। তবে বিদেশে পাচার করা টাকা ফেরানো কঠিন।

সোর্স: আমার দেশ 

মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর