[email protected] বুধবার, ২১ মে ২০২৫
৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

বিলাসবহুল কূটনৈতিক উপহারের ইতিহাস

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ২০ মে ২০২৫ ১৮:০৫ পিএম
আপডেট: ২০ মে ২০২৫ ৬:২৩ পিএম

ফাইল ছবি

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য কাতার রাজপরিবারের 'আকাশের প্রাসাদ' খ্যাত ৪০০ মিলিয়ন ডলারের বিলাসবহুল বিমান উপহার দেওয়ার প্রস্তাবটা যতটা আকর্ষণীয়, ততটাই রাজনৈতিক।

কূটনৈতিক উপহার দেওয়া-নেওয়ার প্রথা কিন্তু নতুন নয়, ইতিহাসে প্রাচীনকাল থেকেই এমন প্রথা দেখা গেছে।

প্রাচীন মিশরে এমন রেওয়াজের নজির মেলে। মিশর, মেসোপটেমিয়া, সিরিয়া ও সাইপ্রাসের রাজারা একে অপরকে দামি উপহার পাঠাতেন। রাজপরিবারের বিয়ে, যুদ্ধজয় বা বন্ধুত্বের বার্তায় পাঠানো হতো এসব উপহার। উপহারে থাকতে হতো রাজকীয় চাকচিক্য। লক্ষ্য ছিল একটাই—প্রতিপত্তি দেখানো। উপহার হতো যতটা জমকালো, ততটাই কূটনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ।

তবে উপহারের বিনিময়ে পাল্টা উপহারও আশা করা হতো। রাজা উপহার পাঠালে ফিরতি উপহার হতে হতো আরও বড়, আরও ব্যতিক্রম। এটাও ছিল একধরনের প্রতিযোগিতা। এই ঐতিহ্য এখনও টিকে আছে। রূপটা বদলেছে, নীতিটা নয়। যেমন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে দেওয়া সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের আতিথেয়তা। ট্রাম্প যদি হঠাৎ বিগ ম্যাক বার্গার চান? চিন্তার কিছু নেই। প্রস্তুত রাখা হয়েছিল ভ্রাম্যমান ম্যাকডোনাল্ডস, একটি ট্রাকেই সাজানো হয় এই রেস্তোরাঁ। 

খ্রিস্টপূর্ব ১৫৫০ থেকে ১০৭০—এই দীর্ঘ পাঁচ শতক ছিল মিশরের ইতিহাসে নিউ কিংডম যুগ। এই সময় ফারাওরা কেবল যুদ্ধ জিততেন না, পুরস্কার দিতেও ছিলেন ওস্তাদ। যারা যুদ্ধে জয় এনে দিতেন, তাদের সোনাদানায় দিয়ে ভরিয়ে দিতেন রাজকীয় ভঙ্গিতে।

একজন ছিলেন ইওয়াই, পদবিতে তিনি ছিলেন 'রাজা-ডান-পাশের-পাখা-ধারক'। তাকে ও তার স্ত্রীকে ডাকা হয়েছিল এক বিশেষ অনুষ্ঠান 'গোল্ড-বেস্টোয়াল' বা সোনা-বিতরণ উৎসবে। ইওয়াই আর তার স্ত্রী এত সোনার গয়না আর উপহার পেয়েছিলেন যে তা বহন করে হাঁটতেই পারছিলেন না। ফারাও আখেনাতেন ও রানি নেফারতিতি রাজপ্রাসাদের বারান্দা থেকে নিজ হাতে ছুড়ে দিচ্ছিলেন সোনার অলঙ্কার। প্রিয় ব্যক্তিবর্গ ও বিশ্বস্ত রাজ সহযোগীদের মাঝে এভাবে সোনা বিতরণ মূলত রাজপরিবারের ধনসম্পদ আর প্রতিপত্তির প্রদর্শনী ছিল।

তবে এই সোনাবৃষ্টি একমুখী ছিল না। উপহারের বদলে পাল্টা উপহারও চাইতেন ফারাওরা; আর তা হতে হতো চোখধাঁধানো। রাজা দ্বিতীয় আমেনহোতেপের আমলে এক উচ্চপদস্থ কর্মচারীর কবরের স্তম্ভ থেকে পাওয়া তালিকা তার প্রমাণ। তিনি ফারাওকে ফিরতি উপহার দিয়েছিলেন—রুপা-সোনার তৈরি রথ, আবলুস কাঠ ও হাতির দাঁতের মূর্তি, অজস্র গহনা, এমনকি শিল্পকর্ম। আরও ছিল দুটি বিশাল হাতির দাঁতের তৈরি হরিণ, যাদের মুখে ছিল ফুল। এছাড়া ছিল বিশাল অস্ত্রভান্ডার—৩০টি রুপা-সোনায় মোড়ানো আবলুস কাঠের লাঠি, ৩৬০টি বাঁকা ব্রোঞ্জের তলোয়ার, ২২০টি হাতির দাঁতের হাতল, আর ৬৮০টি বিরল প্রাণীর চামড়ায় তৈরি ঢাল।

১৮ শতকের শেষ দিকে, বিপ্লব চলাকালীন ফ্রান্সে এর ঠিক উল্টো এক দৃশ্য ছিল। ফরাসি জনগণ মজা পেত রাজাদের সংগ্রহ থেকে বাজেয়াপ্ত করা পশু প্রদর্শনীতে। আফ্রিকার সিংহ, সুইজারল্যান্ডের বাদামি ভালুক—সবকিছুকে খাঁচায় ভরে প্যারিসের রাস্তায় ঘোরানো হতো, যেন একধরনের বিজয় উৎসব।

১৯৫৭ সালে মাও সে তুং পিংপিং ও ঝিঝি নামে দুটি পান্ডা পাঠান মস্কোতে। উদ্দেশ্য ছিল অক্টোবর বিপ্লবের ৪০ বছর পূর্তিতে সোভিয়েত ইউনিয়নকে অভিনন্দন জানানো এবং প্রথম বিশ্বশক্তি হিসেবে পিপলস রিপাবলিক অভ চায়নাকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ। বর্তমানে চীন কৌশল পাল্টেছে। এখন যারা ভালো বাণিজ্য অংশীদার, তাদের পান্ডা ইজারা দেওয়া হয়। তবে শর্তসহ। চুক্তির টাকাগুলো যায় সংরক্ষণ তহবিলে। বাণিজ্যিক সম্পর্ক খারাপ হলে পান্ডা ফিরে আসে। রয়টার্সের তথ্য অনুযায়ী, দুই দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্রে থাকা 'ইয়া ইয়া' নামে এক পান্ডাকে ফেরত নেওয়া হয় ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে। কারণ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে অবনতি।

কূটনৈতিক উপহার কখনোই নিছক সৌজন্য ছিল না। উড়ন্ত প্রাসাদ, মুকুটধারী পোপ আর সামরিক কুচকাওয়াজে মাতোয়ারা প্রেসিডেন্ট—সবকিছু মিলিয়ে আজকের কূটনীতি যেন ব্রোঞ্জ যুগেরই আধুনিক সংস্করণ।  

সোর্স: The Business Standard

মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর